গবেষণা ও রচনা : পলাশ দাস
ছবি ও সম্পাদনা : সৌদিপ শীল

রোজনামচা নিজস্ব প্রতিবেদন : কলকাতার বাবু সংস্কৃতি কলকাতার একটা বর্ণ ময় দিক, এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ | বাবু কালচার শব্দটা সবাই শুনেছি, পড়েছি, দেখেছি | বাংলা নাটক, সিনেমা, যাত্রায় এবং সাহিত্যে এই সংস্কৃতি ধরা পড়েছে না রূপে বার বার | কিন্তু কিভাবে শুরুর হলো এই কালচার, কি তার বৈশিষ্ট, আজ জানবো|

বাবু কালচারের সূচনা হয় আজ থেকে আড়াইশ বছর আগে, নবাবী আমলে | কিন্তু তার উৎপত্তি ও বিস্তার জানতে হলে আমাদের আরো পিছিয়ে যেতে হবে জানতে হবে তৎকালীন বাংলার রাজনৈতিক অবস্থা তার অর্থনৈতিক প্রেক্ষা পট |

সাল 1756 মসনদে নবাব আলীবর্দীর নাতি সিরাজ উদ দৌলা | ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে বিরোধ বাধে তরুণ নবাবের | শেষে মীরজাফর এর বিশ্বাস ঘাতকতা য় পলাশীর যুদ্ধে 1757সালে পরাজয় হয় নবাবের | পরবর্তীতে নবাব রা ছিলো কোম্পানির হাতের পুতুল আসল শাসন ক্ষমতা ছিলো ব্রিটিশ দের হাতেই |
এই ক্ষমতা হস্তান্তর প্রভাব ফেলে ছিলো বাংলার সর্বত্র | ধীরে ধীরে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা হয়ে গেলো বাংলার রাজ ধানী | কলকাতা জৌলুস বাড়তে থাকলো দ্রুত গতি তে | অন্ধকার এ ডুবতে থাকলো মুর্শিদাবাদ |
নবাবী আমলে বাবু ছিলো একটি বিশেষ উপাধি, নবাবের অনুমতি ছাড়া বাবু শব্দ টা নামের আগে ব্যবহার করা যেতোনা | সাধারণত নবাবের অনুগত শিক্ষিত অভিজাত ধনী রা এই উপাধি লাভ করতো |
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতায় এসে বুঝে ছিলো বাংলার এই বাবু সমাজ কে অনুগত করে রাখতে পারলে তাদের শাসন করতে সুবিধা হবে তাই ব্রিটিশ রা বাবু কালচার কে উৎসাহ দেয় | তাদের প্রভাব ও খমতা বৃদ্ধি করে | আরো নতুন নতুন উপাধি তৈরী হয় যেমন রাজা, রায়, রায় চৌধুরী, রায় বাহাদুর ইত্যাদি |
ব্রিটিশ আমলে এক নতুন অভিজাত শ্রেণীর তৈরী হলো | শিক্ষা ও বংশ পরিচয় কে ছাপিয়ে গেলো অর্থ | কেউ বা ব্যবসা করে কেউ আবার রাজ কর্মচারী হয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে রাত রাতি হয়ে গেলো বাবু |কলকাতার বাবু কালচারের তখন স্বর্ণ যুগ বলা যায় | বাবুয়ানা ও সৌখিনতা প্রায় সমার্থক শব্দ | এর কারণ বাবু হওয়ার প্রধান শর্ত ছিলো ওই সৌখিনতা | শুধু অর্থ উপার্জন নয় অর্থ ব্যয়ের প্রতিযোগিতা এ নামতে হবে | তবেই বাবু উপাধি স্বার্থক হবে এই ছিলো মানসিকতা |ব্রিটিশ রা চেয়েছিল সম্পদ শালী এক চাটুকার এর দল তৈরী করতে | তাই হয়েছিল | দামি গাড়ি, লক্ষ টাকার বাইজি, বিশাল বিশাল বাড়ি, পায়রা ওড়ানো, রক্ষিতা কে নিয়ে গান বাজনা করে আর মদ খেয়ে রাতের পর রাত কাটানো ছিলো এই ধনী বাবু সমাজের প্রতিদিন এর জীবন |

কালী প্রসন্ন সিংহ
কালী প্রসন্ন সিংহের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি সেকালের বাবুদের স্ত্রী রা কোনো রাতেই তাদের স্বামী দের মুখ দেখতো না | কারন বাবুদের প্রতিটা রাত কাটতো বাইজি বা রক্ষিতা র সাথে নাচ মহলে |
বঙ্কিম চন্দ্র তার বাবু নামক রম্য রচনায় লিখে ছিলেন যিনি দূর্গা উৎসব এর উদ্দেশ্য দূর্গা পুজা করবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষী পুজো করবেন, উপপত্নী র অনুরোধ এ স্বরূস্বতী পুজো করবেন এবং মাংস খাওয়ার লোভে পাঠা বলী দেবেন তিনি ই বাবু |
শিক্ষা বিদ, ঐতিহাসিক , সাহিত্যিক শিবনাথ শাস্ত্রী ‘বাবু’ দের সম্পর্কে লিখেছেন,”বাবু মহাশয়েরা দিনে ঘুমাইয়া,ঘুড়ি উড়াইয়া,বুলবুলির লড়াই দেখিয়া,সেতার ,এসরাজ,বীণা প্রভৃতি বাজাইয়া,কবি,ফুল আখড়াই,হাফ আখড়াই,পাঁচালী প্রভৃতি শুনিয়া রাত্রি কালে বারাঙ্গানাদিগের গৃহে গৃহে গীত বাদ্য ও আমোদ প্রমোদ করিয়া কাল কাটাইত এবং খড় দহের ও ঘোষপাড়ার মেলা এবং মাহেশর স্নান যাত্রা প্রভৃতির সময়ে কলিকাতা হইতে বারাঙ্গানা দিগ কে সঙ্গে লইয়া দলে দলে নৌকা যোগে আমোদ করিতে যাইতেন।”

কলকাতার বিখ্যাত আট বাবু ছিলেন।
নীলমনি হালদার।
রামতানু দত্ত।
গোকুলচন্দ্র মিত্র।
রাজা রাজকৃষ্ণ।
কালীপ্রসন্ন সিংহের পূর্বপুরুষ ছাতু সিংহ।
দর্পনারায়ণ ঠাকুর ।
রাজা সুখময় রায়।
এবং চোরাবাগান মিত্র বংশের এক বাবু। এরা ছিলেন প্রধান, তাছাড়া আরো অনেক বাবু গজিয়ে উঠেছিলো রাতারাতি |

জোড়া সাঁকো ঠাকুর বাড়ির সদস্য রাও বাবুয়ানা তে খুব একটা পিছিয়ে ছিলোনা | দ্বারকা নাথ ঠাকুর তার বিলাসিতা ও সৌখিনতার জন্য বিশেষ ভাবে পরিচিত ছিলেন |
কিছু প্রতিভা সম্পন্ন,ব্যতিক্রমী চরিত্রের বাবুও ছিলো সে সময় যেমন আশুতোষ ও প্রমথনাথ। এঁরা যথাক্রমে সাতু ( ছাতু ) বাবু ও লাটু বাবু নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। আশুতোষ বাবু ছিলেন তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ সেতারিদের মধ্যে অন্যতম। লাটু বাবু যেমন ছিলেন দানশীল, তেমন ছিলেন বিলাসী। এই ছাতু বাবুর নামেই কিন্তু ছাতু বাবুর বাজার |
বাবুদের বিলাসিতা বা সৌখিনতা কখনো কখনো হাস্য কর পর্যায় পৌছাতো | কেউ কুকুরের বিয়েতে হাজার হাজার টাকা খরচ করছে তো কেউ পোষা বেড়ালের বিয়েতে 10 টা গ্রামের লোক নিমন্ত্রণ করে খাওয়াচ্ছে | কেউ পায়রার পেছনে লক্ষ টাকা উড়িয়ে দিচ্ছে | সোনা যায় কিছু ধনী বাবু জুতোর ডগায় হিরে বসিয়ে রাখতেন | ভাবা যায় !
সোনা যায় রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র তার পোষা বাঁদরের বিয়েতে এক লক্ষের বেশি টাকা খরচ করে তাক লাগিয়ে দিয়ে ছিলেন | বানরের মাথায় ছিলো হিরে মুক্ত খচিত মুকুট | সঙ্গে বিলাস বহুল পালকি ও শোভাযাত্রা |
রাজা ইন্দ্র নারায়ণ রায় তার বিড়ালের বিয়েতে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন বলে সোনা যায় | নিমাই চাঁদ মল্লিক এর নাতি রাম রতন মল্লিক এর বিয়েতে চিৎ পুরের দুমাইল রাস্তা ভেজানো হয়েছিলো খাঁটি গোলাপ জল দিয়ে |ঘোড়া গাড়িতে বাবুরা হাজার হাজার টাকা উড়িয়ে দিতো | কত রকম বাহারের গাড়ি ছিলো সেকালে, ফিটন, বগি,বৃতস কাস, পালকি ও হতো মহা মূল্য বান, সৌখিন, জমকালো| পড়ে মোটর গাড়ি উঠলে বাবুরা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বিদেশ থেকে তা আনাতে শুরু করে |
মদ ছাড়াও বাবুরা সাহেব দের থেকে আরেকটা জিনিস শিখেছি লেন তা হলো নাট্য চর্চা | আশুতোষ দেব বা ছাতু বাবু, শোভাবাজার রাজ বাড়ির বাবুরা এবং ঠাকুর বাড়ির বাবুরা নাটকে অর্থাৎ ব্যয় করলেন | এই ভাবে বাংলা থিয়েটারের ভিত্তি স্থাপন হলো | পড়ে গিরিশ ঘোষ এর হাত ধরে তা আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল | শুধু নাটক কেনো, বাংলা গান, যাত্রা এবং পরবর্তীতে চলচ্চিত্র বাবুদের অর্থ সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সম্ভব ছিলোনা| সেদিক দিয়ে বাংলা শিল্প ও সংস্কৃতি জগৎ বাবুদের কাছে কিছুটা ঋণী |

কালের নিয়মে সব সাম্রাজ্যের ই পতন হয় |ভারত ও একদিন স্বাধীন হলো | দেশীয় রাজা ও জমিদার দের দুর্দিন ঘনিয়ে এলো | পরে 1950 সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে এদেশে জমিদারি প্রথা উঠে যায় |একদিকে বেহিসাবি খরচ করে আর্থিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়া অন্য দিকে ব্রিটিশ দের চলে যাওয়া তার সাথে প্রজা স্বার্থে তৈরী কঠোর সব আইন |ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে শুরু করলো বাবুদের গৌরব ময় দিন |একদিন যে বাবুদের দাপটে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো আজ তারা প্রায় নিঃস্ব | জীবিত শরিক রা বেশি ভাগ ই বিদেশে বা অন্য কোথাও কর্ম রত | ঐতিহ্য বলতে ওই দূর্গা পুজা বা বিশেষ কোন অনুষ্ঠানে একত্রিত হওয়া | বাবুদের সেই সুদিন থাক বা না থাক, বাঙালি আজও বিশ্বের দরবারে বাবু নামেই পরিচিত | বাবুয়ানা আমাদের অস্তিত্ব আমাদের সংস্কৃতির একটা অঙ্গ হয়ে গেছে তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না |